সৈয়দপুর ০৮:২৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ২৮ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জীবিকানির্বাহে বৃদ্ধ মোস্তাকিম স্ত্রী সহ ৩ যুগ ধরে বুক দিয়ে ঘানি টানেন

ফজল কাদির
  • আপডেট সময় : ১২:০৫:৪০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ অক্টোবর ২০২৫ ৭২ বার পড়া হয়েছে
চোখ২৪.নেট অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

ফজল কাদির: সংসারে টানাপোড়েন পিছু ছাড়ে না। তাই বৃদ্ধ কলু মোস্তাকিনের(৭০) ঘানি টানতে ভাগ্যে একটা বলদও জুটেনি। বাধ্য হয়েই ৯ সদস্যের সংসার চালাতে স্ত্রী ছকিনা (৬০) সহ বুক ও কোমর দিয়ে ঘানি টেনে সরিষা থেকে তেল করেন। প্রায় তিন যুগ ধরে মাথার ঘাম ঝড়িয়ে এই কাজটি করছেন মোস্তাকিম দম্পত্তি। তার জীবিকার অবলম্বনটি অনেকটা সিনেমার গল্পের মত মনে হয়। বাস্তবে অনেক নির্মম গল্পগাঁথা তাকে এই কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি করিয়েছে।

ঘানিটানা ক্লান্তিহীন মানুষটির ঠিকানা হলো নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের বাহাগিলী ইউনিয়নের উত্তর দুড়াকুটি পাগলাটারি গ্রামে।

পৈত্রিকসুত্রে চাষাবাদের জমি পাননি মোস্তাকিন আলী। কলু পেশায় ঝুঁকে পড়েন। কলের ঘানি আসার আগেই সংসারে সুবাতাস বইছিল। তেজদীপ্ত বলদ দিয়ে ঘানির কাজ চলছিল সেই সময়। কালের বিবর্তনে টান পরে ঘানির জীবিকায়। সংসারে সদস্য সংখ্যা বেড়ে যায়। অনটন চেপে বসে কাঁধের উপর। তাই বাধ্য হয়েই জীবিকার একমাত্র অবলম্বন বলদ বিক্রি করে ঘানি টানেন স্ত্রী সহ নিজেই। অনটনের জন্য একটি জীর্ণ গরুও ভাগ্যে আর জোটে না। তিন যুগ ধরে এই দম্পত্তি ঘানি টেনেই চলছেন।

তারাগঞ্জের বাজার থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে সরিষা কিনে আনেন মোস্তাকিন। দুপুর নাগাদ বাড়ি ফিরে শুরু হয় ঘানি টানা। সরিষা পিষতে কাঠের গুঁড়ি আর ভারি পাথর ঘানির জন্য প্রাসঙ্গিক অনুসঙ্গ। তাই এই ভারী অনুসঙ্গ টানতে স্ত্রী ছকিনা বেগমও সাথে থাকেন। শরীরে অঝোরে ঘাম ঝড়লেও থেমে থাকে না তাদের ভারী টানা।
দিনে পাঁচ কেজি সরিষা ভেঙে প্রায় দুই লিটার তেল আর তিন কেজির মতো খৈল পাওয়া যায়। বিকেলে বাজারে গিয়ে কেজি প্রতি ২০০ টাকায় তেল বিক্রি করেন। খরচ বাদে হাতে থাকে দিনে দুই থেকে আড়াইশ টাকা। এই আয় দিয়েই চলে সংসার। তবে বয়সের ভাড়ে এখন ঘানি টানা আর আগের মতো হয়ে উঠে না। শরীর হাঁফিয়ে উঠে। ঘন ঘন দম নিয়ে দিনে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা চলে তাদের ঘানি টানার কাজ। বড় ছেলে মিলন মিয়া(৪৫) সাদাসিদে ধরণের। শরীরে অপুষ্টির ছাপ। পার্টটাইম রেস্টুরেন্টে কাজ করেন। শ্রম অনুযায়ী মজুরী বঞ্চিত হয়। তাই প্রায় বাবার সংসারে বোঝা হয়ে থাকেন। মেজ ছেলে শাহ্জাহান((৩৫) একমাত্র কর্মক্ষম পুরুষ। কাঁেধ দুটি টিউমার হওয়ায় ঠিকমত কৃষিকাজ করতে পারেন না। ছোট ছেলে আদম আলী(২৫) দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি। একটি চোখে ঝাপসা দেখার কারণে ঢাকার একটি রেষ্টুরেন্টে গালমন্দ সহ্য করে দিন শেষে কম মজুরী গুনেন। মোস্তাকিনের ৬ বছরের নাতনি শাহনাজ শারীরিক প্রতিবন্ধি। বাড়ীর সাথেই বাড়ীমধুপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সে ১ম শ্রেণিতে পড়ে। চার মেয়েকে পাত্রস্থ করেছেন কয়েক বছর আগে। এর মধ্যে যৌতুকের কারণে স্বামী পরিত্যাক্তা হয়ে মেয়ে রূপালী (২০) এখন তার বাড়ীতে আশ্রিত।

মোস্তাকিনের বাড়ির আঙিনায় জোড়াতালি দেওয়া টিনের ছাপড়ার ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে কাঠের ঘানি। প্রতিদিন দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত ঘানি টেনে চলেন এই বৃদ্ধ দম্পতি। তাদের একমাত্র ভরসা এই ঘানি। তবে বাড়ির টিনের ঘরটিতেও বৃষ্টির পানি চুইয়ে পড়ে। প্রতিবেশী আনোয়ারা(৪০) বলেন, তার কষ্টের কথা শুনে নীলফামারীর বিশিষ্ঠ ব্যবসায়ী হাজী কামাল উদ্দিন একটি বকনা গরু দিয়েছিল। এটি রোগাক্রান্ত হলে খুব সস্তা মুল্যে বিক্রি করে দেন। কিশোরগঞ্জ ইউএনও অফিস থেকে কিছুদিন আগে একটি গরু দেয়ার পরই ল্যম্পিস্কিনে আক্রান্ত হয়ে তা মারা যায়।

মোস্তাাকিন বলেন, প্রায় পৌঢ়কাল থেকেই ঘানি টানা শুরু হয়। এখনও অবিরাম চলছে এই জীবণযুদ্ধ। এখন হাঁপিয়ে উঠেছি। কেউ যদি একটা গরু দিয়ে সাহায্য করত, তাহলে সেই গরু দিয়েই ঘানি টেনে সংসারটা ভালোভাবে চালাতে পারতাম। আমার গরু কেনার সামর্থ নেই। তাই বুক দিয়েই ঘানি টানি।

প্রতিবেশী আবুল কালাম বলেন, এই বয়সে বুক দিয়ে ঘানি টানা কষ্টের কাজ। আমি দীর্ঘ সময় ধরে দেখছি তারা এভাবে ঘানি টেনে সংসার চালাচ্ছে। বিত্তবানরা গরু দিয়ে সাহায্য করলে সেকেলে পদ্ধতিতে ঘানির মাধমে খাঁটি সরিষার তেলের অভাব মোচন হবে।

এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) প্রীতম সাহা বলেন, আমরা শীঘ্রই হতদরিদ্র পরিবারটির পাশে দাড়াব।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য


জীবিকানির্বাহে বৃদ্ধ মোস্তাকিম স্ত্রী সহ ৩ যুগ ধরে বুক দিয়ে ঘানি টানেন

আপডেট সময় : ১২:০৫:৪০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ অক্টোবর ২০২৫

ফজল কাদির: সংসারে টানাপোড়েন পিছু ছাড়ে না। তাই বৃদ্ধ কলু মোস্তাকিনের(৭০) ঘানি টানতে ভাগ্যে একটা বলদও জুটেনি। বাধ্য হয়েই ৯ সদস্যের সংসার চালাতে স্ত্রী ছকিনা (৬০) সহ বুক ও কোমর দিয়ে ঘানি টেনে সরিষা থেকে তেল করেন। প্রায় তিন যুগ ধরে মাথার ঘাম ঝড়িয়ে এই কাজটি করছেন মোস্তাকিম দম্পত্তি। তার জীবিকার অবলম্বনটি অনেকটা সিনেমার গল্পের মত মনে হয়। বাস্তবে অনেক নির্মম গল্পগাঁথা তাকে এই কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি করিয়েছে।

ঘানিটানা ক্লান্তিহীন মানুষটির ঠিকানা হলো নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের বাহাগিলী ইউনিয়নের উত্তর দুড়াকুটি পাগলাটারি গ্রামে।

পৈত্রিকসুত্রে চাষাবাদের জমি পাননি মোস্তাকিন আলী। কলু পেশায় ঝুঁকে পড়েন। কলের ঘানি আসার আগেই সংসারে সুবাতাস বইছিল। তেজদীপ্ত বলদ দিয়ে ঘানির কাজ চলছিল সেই সময়। কালের বিবর্তনে টান পরে ঘানির জীবিকায়। সংসারে সদস্য সংখ্যা বেড়ে যায়। অনটন চেপে বসে কাঁধের উপর। তাই বাধ্য হয়েই জীবিকার একমাত্র অবলম্বন বলদ বিক্রি করে ঘানি টানেন স্ত্রী সহ নিজেই। অনটনের জন্য একটি জীর্ণ গরুও ভাগ্যে আর জোটে না। তিন যুগ ধরে এই দম্পত্তি ঘানি টেনেই চলছেন।

তারাগঞ্জের বাজার থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে সরিষা কিনে আনেন মোস্তাকিন। দুপুর নাগাদ বাড়ি ফিরে শুরু হয় ঘানি টানা। সরিষা পিষতে কাঠের গুঁড়ি আর ভারি পাথর ঘানির জন্য প্রাসঙ্গিক অনুসঙ্গ। তাই এই ভারী অনুসঙ্গ টানতে স্ত্রী ছকিনা বেগমও সাথে থাকেন। শরীরে অঝোরে ঘাম ঝড়লেও থেমে থাকে না তাদের ভারী টানা।
দিনে পাঁচ কেজি সরিষা ভেঙে প্রায় দুই লিটার তেল আর তিন কেজির মতো খৈল পাওয়া যায়। বিকেলে বাজারে গিয়ে কেজি প্রতি ২০০ টাকায় তেল বিক্রি করেন। খরচ বাদে হাতে থাকে দিনে দুই থেকে আড়াইশ টাকা। এই আয় দিয়েই চলে সংসার। তবে বয়সের ভাড়ে এখন ঘানি টানা আর আগের মতো হয়ে উঠে না। শরীর হাঁফিয়ে উঠে। ঘন ঘন দম নিয়ে দিনে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা চলে তাদের ঘানি টানার কাজ। বড় ছেলে মিলন মিয়া(৪৫) সাদাসিদে ধরণের। শরীরে অপুষ্টির ছাপ। পার্টটাইম রেস্টুরেন্টে কাজ করেন। শ্রম অনুযায়ী মজুরী বঞ্চিত হয়। তাই প্রায় বাবার সংসারে বোঝা হয়ে থাকেন। মেজ ছেলে শাহ্জাহান((৩৫) একমাত্র কর্মক্ষম পুরুষ। কাঁেধ দুটি টিউমার হওয়ায় ঠিকমত কৃষিকাজ করতে পারেন না। ছোট ছেলে আদম আলী(২৫) দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি। একটি চোখে ঝাপসা দেখার কারণে ঢাকার একটি রেষ্টুরেন্টে গালমন্দ সহ্য করে দিন শেষে কম মজুরী গুনেন। মোস্তাকিনের ৬ বছরের নাতনি শাহনাজ শারীরিক প্রতিবন্ধি। বাড়ীর সাথেই বাড়ীমধুপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সে ১ম শ্রেণিতে পড়ে। চার মেয়েকে পাত্রস্থ করেছেন কয়েক বছর আগে। এর মধ্যে যৌতুকের কারণে স্বামী পরিত্যাক্তা হয়ে মেয়ে রূপালী (২০) এখন তার বাড়ীতে আশ্রিত।

মোস্তাকিনের বাড়ির আঙিনায় জোড়াতালি দেওয়া টিনের ছাপড়ার ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে কাঠের ঘানি। প্রতিদিন দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত ঘানি টেনে চলেন এই বৃদ্ধ দম্পতি। তাদের একমাত্র ভরসা এই ঘানি। তবে বাড়ির টিনের ঘরটিতেও বৃষ্টির পানি চুইয়ে পড়ে। প্রতিবেশী আনোয়ারা(৪০) বলেন, তার কষ্টের কথা শুনে নীলফামারীর বিশিষ্ঠ ব্যবসায়ী হাজী কামাল উদ্দিন একটি বকনা গরু দিয়েছিল। এটি রোগাক্রান্ত হলে খুব সস্তা মুল্যে বিক্রি করে দেন। কিশোরগঞ্জ ইউএনও অফিস থেকে কিছুদিন আগে একটি গরু দেয়ার পরই ল্যম্পিস্কিনে আক্রান্ত হয়ে তা মারা যায়।

মোস্তাাকিন বলেন, প্রায় পৌঢ়কাল থেকেই ঘানি টানা শুরু হয়। এখনও অবিরাম চলছে এই জীবণযুদ্ধ। এখন হাঁপিয়ে উঠেছি। কেউ যদি একটা গরু দিয়ে সাহায্য করত, তাহলে সেই গরু দিয়েই ঘানি টেনে সংসারটা ভালোভাবে চালাতে পারতাম। আমার গরু কেনার সামর্থ নেই। তাই বুক দিয়েই ঘানি টানি।

প্রতিবেশী আবুল কালাম বলেন, এই বয়সে বুক দিয়ে ঘানি টানা কষ্টের কাজ। আমি দীর্ঘ সময় ধরে দেখছি তারা এভাবে ঘানি টেনে সংসার চালাচ্ছে। বিত্তবানরা গরু দিয়ে সাহায্য করলে সেকেলে পদ্ধতিতে ঘানির মাধমে খাঁটি সরিষার তেলের অভাব মোচন হবে।

এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) প্রীতম সাহা বলেন, আমরা শীঘ্রই হতদরিদ্র পরিবারটির পাশে দাড়াব।