প্রশ্নফাঁসঃ ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে শোকজ

- আপডেট সময় : ০৪:৪৪:১৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ৪৭ বার পড়া হয়েছে

আব্দুল হাকিম, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ চলতি এসএসসি পরীক্ষায় দায়িত্বে অবহেলা ও গাফিলতির কারণে কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কুমার দেব শর্মার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় চলতি এসএসসি, দাখিল, এসএসসি (ভোকেশনাল) এবং দাখিল (ভোকেশনাল) পরীক্ষায় শত-শত শিক্ষার্থীর জন্য বোর্ড কর্তৃক পরীক্ষার জন্য প্রদত্ত কয়েক হাজার প্রশ্নপত্র সেটের প্যাকেট পাঠিয়ে দেয়া হয়। এসব প্যাকেট থেকে প্রশ্ন সটিং এবং যাচাই-বাছাই করার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একজন প্রতিবেদন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেন। এমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কুমার দেব শর্মাকে শোকজ (কারণ দর্শানোর চিঠি) করেছেন জেলা প্রশাসক কুড়িগ্রাম। গত বুধবার তাকে এ শোকজ করে আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে তাকে শোকজের জবাব দিতে বলা হয়েছে জেলা প্রশাসকের দেয়া পত্রে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, বিধি মোতাবেক ইউএনও পরীক্ষার ব্যাপারে চিঠি করেছেন। তারপরেও কোন গাফিলতি আছে কিনা বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইউএনওকে শোকজ করা হয়েছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তাকে এর জবাব দিতে বলা হয়েছে। শোকজের জবাব পেলে পরবর্তী করনীয় ঠিক করা হবে।
এদিকে জেলা শিক্ষা অফিসার শামছুল আলম বলেন, বরখাস্ত হওয়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুর রহমান বৃহস্পতিবার অসুস্থ হয়ে ভূরুঙ্গামারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন। এরপর তার অবস্থার অবনতি হলে শুক্রবার দুপুরে তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। উচ্চ রক্তচাপসহ নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে এ কর্মকর্তার।
তিনি আরো জানান, দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের তিন সদস্যের গঠিত তদন্ত কমিটির দল তদন্ত শেষে শুক্রবার বিকেলে ফেরত গেছেন। এছাড়া প্রশ্নপত্র সুটিং এর দায়িত্বের ব্যাপারে বলেন, এক বা দুদিনে একজন মানুষের পক্ষে কয়েক হাজার প্রশ্নের প্যাকেট যাচাই বাাই করা অসম্ভব। এ জন্য ভুরুঙ্গমারীর ৬টি পরীক্ষা কেন্দ্রের জন্য কম পক্ষে ৬ জনকে কয়েকদিন সময় দিয়ে প্রশ্ন সটিং করার দায়িত্ব দিলে নির্ভুলভাবে সঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারতো। প্রশ্ন ফাঁসের এ দায় থেকে সংশ্লিষ্ট কেউ দায় এড়াতে পারেন না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কুমার দেব শর্মা গত ১১ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষরিত ০৫.৪৭. ৪৯০৬. ০০০.১৩.০২৩.২২.৮৫৯ নং স্মারকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ও অন্যান্য গোপনীয় কাগজ পত্রাদি যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুর রহমানকে দায়িত্ব দেন। পত্রে বলা হয় ভূরুঙ্গামারী থানায় প্রশ্ন পত্র ও অন্যান্য গোপনীয় কাগজপত্রাদি সংরক্ষিত রয়েছে। উক্ত সিলগালাকৃত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ও অন্যান্য গোপনীয় কাগজপত্রাদি বিবরণী মোতাবেক সঠিক আছে কিনা তা যাচাই-বাছাই করে ১৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের করার জন্য অনুরোধ করা হয়। এই পত্রের অনুলিপি দেয়া হয় ভূরুঙ্গামারী থানার অফিসার ইনচার্জসহ উপজেলার ৬টি পরীক্ষা কেন্দ্রের সকল সচিবগণকে।
পত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, পরীক্ষার সময়সূচি অবশ্যই খামের উপরে লিখতে হবে। এছাড়াও একই তারিখে ইউএনও’র স্বাক্ষরিত ০৫.৪৭. ৪৯০৬. ০০০.১৩.০২৩.২২নং স্মারকে এক অফিস আদেশে ভূরুঙ্গামারী উপজেলার বিভিন্ন কেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তাদের সকলকে পরীক্ষার দিন গুলোতে থানা হতে নির্ধারিত প্রশ্নপত্র উত্তোলন নিশ্চিত করে এবং পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে সার্বক্ষনিক কেন্দ্রে উপস্থিত থেকে পরীক্ষা গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ভূরুঙ্গামারী থানায় প্রশ্ন বাছাইয়ের সর্টিং করার সময় নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্র সচিব লুৎফর রহমান দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপজেলা মাধ্যমিক অফিসার আব্দুর রহমানের যোগসাজসে বাংলা ১ম পত্রের প্রশ্নপত্রের প্যাকেটের ভিতর বাংলা-২য় পত্র, ইংরেজি ১ম ও ২য় পত্রের প্রশ্ন পত্রের একটি করে খাম ঢুকিয়ে নেন এবং প্যাকেট সীলগালা করেন। তার ওপর স্বাক্ষর করেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমান। বাংলা ১ম পত্রের পরীক্ষার দিন যথা নিয়মে থানা থেকে বাংলা ১ম পত্রের প্যাকেট এনে তা খুলে বাংলা ২য় পত্র, ইংরেজি ১ম ও ২য় পত্রের খামটি কৌশলে সরিয়ে ফেলেন কেন্দ্র সচিব লুৎফর রহমানসহ তার সহযোগিরা। এ সময় কেন্দ্রে দায়িত্বরত ট্যাগ অফিসার বোর্ডের দেয়া তালিকা অনুযায়ী পাঠানো প্রশ্নে পত্রের খাম গণনা করার নিয়ম থাকলেও তারা দায়িত্ব অবহেলা করে তা করেনি।
পরে প্রধান শিক্ষক কয়েকজন শিক্ষকের সহায়তায় ফাঁস করা প্রশ্নপত্রের হাতে লেখা উত্তরপত্র তৈরী করে ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা মূল্যে বিক্রি করেন। পরীক্ষার আগের রাতে ফাঁস হওয়া উত্তর পত্রের সাথে পরের দিন পরীক্ষার প্রদত্ব প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল পাওয়া যায়। আর এসব উত্তর পত্র অনেকেই মোবাইলের মাধ্যমে উত্তরপত্র গোপনে ২শ থেকে ৫শ টাকা বিক্রি করেন অন্যান্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নিকট।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক উপজেলার কর্মকর্তারা বলেন, বোর্ডের নিয়মানুযায়ী পরীক্ষা শুরুর ৫/৭ দিন আগে কেন্দ্র সচিব বা তার প্রতিনিধি এবং ট্যাগ অফিসারের মাধ্যমে ট্রাংকে রক্ষিত প্রশ্নপত্রের প্যাকেটের সাথে “প্রশ্নপত্রের চাহিদা” সঠিক ভাবে যাচাইয়ের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। কোন গড়মিল থাকলে সাথে সাথে বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে লিখিতভাবে জানাতে হবে।
কিন্তু ইউএনও সেই কাজ না করে এক/দু’দিনের মধ্যে একজন কর্মকর্তাকে দিয়ে প্রশ্নপত্র সটিং করে প্রতিবেদন দেবার নির্দেশ দেন। একজন কর্মকর্তার পক্ষে হাজার, হাজার প্রশ্নপত্র এক/ দু’দিনের মধ্যে যাচাই-বাছাই, কাগজে স্বাক্ষর করা এবং নজরদারী-হিসাব করে প্রতিবেদন দেয়া প্রায় অসম্ভব। আর এই সুযোগে অসাধু কিছু শিক্ষক প্রশ্ন পত্র কৌশলে বের করেছেন। ইউএনও যদি শুরুতেই তার দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করতো তাহলে প্রশ্ন ফাঁসের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি ঘটার সম্ভাবনা ছিল না। এতে করে এসএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষাকে গুরুত্ব না দেয়ায় প্রশ্ন ফাঁসের দায় থেকে ইউএনও এড়াতে পারেন না।
ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কুমার দেব শর্মাকে একাধিবার ফোনে কল দিলেও তিনি তার ফোনটি রিসিভ করেননি। ফলে এ ব্যাপারে তার কোন মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।