বহুমাত্রিক উদ্যোগে দুধে-ভাতে থাকতে চান কামরুল হোসেন কাজল

- আপডেট সময় : ১২:৪৪:০৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫ ৩৯ বার পড়া হয়েছে

ফজল কাদির: বহুমাত্রিক উদ্যোগে দুধে-ভাতে থাকতে চান আবরার এগ্রো ফার্মের স্বত্বাধিকারী মোঃ কামরুল হোসেন কাজল। পেশায় একজন উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক। পরিবার ও পড়শিদের অগ্রযাত্রার ভাবনা নিয়ে গড়ে তোলেন গরু মোটাতাজাকরণ খামার। কোভিট-১৯ কালীন বৈরী পরিস্থিতিতে নিজ জমিতে ১৫টি মাঝারী ও জীর্ণ এঁড়ে গরু দিয়ে খামার শুরু করেন কাজল। ভাল মুনাফা আসায় শঙ্কা কাটে। চার মাসে গরু মোটাতাজা করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বিক্রি করেন। খামারে বছরে তিন বার বিকি-কিনি হয়। প্রথম বছরে ১২ লক্ষাধিক টাকা লাভ আসায় কর্মস্পৃহা বেড়ে যায় সফল উদ্যোক্তা হওয়ার।
মোঃ কামরুল হোসেন কাজল নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার উত্তর চাঁদখানা গ্রামে পৌনে তিন একর জমিতে গড়ে তুলেন আবরার এগ্রো ফার্ম। তবে খামারের ৭৩ শতক জমি নিজের ও বাকী জমিটা চুক্তিতে নেয়া। এই খামারে গরুর পাশাপাশি ছাগল, হাস,দেশী মুরগী ও কবুতর চোখে পড়ার মত। পাহারাদার হিসাবে তিনটি কুকুরও সব সময় থাকে। এদের কারণে খামারের ৪ জন নৈশ প্রহরী নিরাপদ সময় কাটান।
উত্তরাঞ্চলের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র ভিন্নজগৎ-কিশোরগঞ্জ সড়ক সংলগ্ন আরসিসি পিলারে বাধাঁনো ড্রাগন ফলের বাগান পথচারীদের মন কাড়ে। এটি খামারের প্রায় তিন বিঘা জমিতে বিস্তৃত। এই খামারে রয়েছে- আরো দুস্পাপ্য শরিফা বাগান, উচ্চ ফলনশীল পেঁয়ারাবাগান, দেশী লেবুবাগান, শীত ও গ্রীষ্মকালীন শাক-সবজিবাগান, কেঁচো কম্পোষ্ট সার সহ জিআই তারের বেস্টনী বেড়ার ‘বাইন্ডিং কারখানা’। সবকিছু মিলে যেন আদর্শ কৃষকবাড়ী।
আবরার এগ্রো ফার্মের একটি ‘সুপার সপ’ও রয়েছে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে। এটির নাম ‘ টুকিটাকী ’। স্থানীয় এক তরুণ ‘টুটিটাকী’র দেখভাল করেন। দোকানের চাহিদা অনুযায়ী খামারের ফলজ ও প্রাণিজ পণ্য দুরপাল্লার ঢাকাগামী বাসে পাঠানো হয়। অনেক লোকের কর্মসংস্থান হয় এই খামারে। অঢেল সম্পদের মালিক হতে চান না খামারী কামরুল হোসেন কাজল। তিনি শুধু পরিবার-পরিজন নিয়ে দুধে ভাতে থাকতে চান বলে জানান। পনের শতক গরুর খামার দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও পরে বহুমাত্রিক উদ্যোগ নিয়ে এলাকার খেটে খাওয়া মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। এর আয় দিয়ে খামারের আকার দাঁড়িয়েছে পৌনে তিন একর।
সফল খামারী কাজল জানান, জুন থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত ড্রাগনফল বাজারজাত করা হয়। পরিচর্চা, বিদ্যুৎ, সার, সেচ খরচ বাদ দিয়ে এখান থেকে বছরে ৭ থেকে ৯ লাখ টাকা আয় করি। এখানে সাথী ফসল হিসাবে শীতকালীন সবজি ফুলকপি , বাধাকপি, ব্রোকলি,ওলকপি, কাঁচামরিচ, বেগুন,ক্যোপসিকাম ও বিটরুটও চাষ করি। আর গ্রীস্মকালীন সবজি শশা, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, ও ঢ্যাঁড়স চাষ করি। সবজি থেকেও বছরে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা আয় হয়। সাথী ফসল চাষের কারণে ড্রাগনফল বাগানে সাড়া বছরই শ্রমিকরা কাজে নিয়োজিত থাকে।
খামারের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে উচ্চ ফলনশীল পেঁয়ারা। এখানে থাই-৫ ও থাই -৮ জাতের পেঁয়ারা চাষ হয়। মাত্র ৪০ শতাংশ জমিতে দেড় থেকে ২ লাখ টাকা বছরে আয় হয়। দুষ্পাপ্য শরিফা বাগান রয়েছে পশ্চিম প্রান্তে। প্রায় ষাটটি মাঝারী গোচের শরিফা গাছে থোকা থোকা শরিফা হয়। রাজধানী সহ শহর এলাকায় এর কদর বেশী। অনেক সময় তিন থেকে চার শত টাকায় প্রতিকেজি শরিফা বিক্রি হয় বলে বাগানের দায়িত্বে থাকা ইলিয়াছ হোসেন(৩২) জানান। খরচ বাদ দিয়ে শরিফা থেকে বছরে আয় হয় দুই লক্ষাধিক টাকা। খামারের চারপাশে দেশী রসালো লেবু দিয়ে বেষ্টিত। এগুলো বিচিবিহীন লম্বা আকৃতির লেবু। মৌসুমে অন্ততঃ ৫০ হাজার টাকার লেবু বিক্রি হয়।
খামারের বাইরে থাকা বড় একটি আমবাগানের ছায়ার কারণে পরিত্যাক্ত স্থানে কেঁচো কম্পোষ্ট সারের ভ্যেনু রয়েছে। খামারে থাকা বায়োগ্যাস প্লান্টের ‘বাসী’ গোবর থেকে ২৮টি রিং পাইপে কেঁচো কম্পোষ্ট সার তৈরী করা হয়। উৎকৃষ্ট জৈব্য সার হিসাবে খামারে প্রয়োগ করা হয়। চাহিদা মিটেও স্থানীয় কৃষিজীবিদের কাছে ১৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় বলে কর্মরত নারী শ্রমিক মর্জিনা বেগম (৩৫) জানান।
গরুর খামারের পাশাপাশি নানা জাতের ছাগল পালেন কাজল। প্রায় ১ বিঘা জমিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ছাগল পালনের খামার রয়েছে। এতে রয়েছে বøাক ব্যাঙ্গল, বিটল, যমুনাপারী সহ স্থানীয় জাতের প্রায় ২০টি ছাগল। খামারের সাথেই উন্নতজাতের নেপিয়ার ঘাস। গবাদী পশুর চাহিদা পূরণ হয়েও উদ্বৃত্ত ঘাস পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন বলে কাজল জানান।
খামারে কর্মরত দুই জন শ্রমিক প্রশিক্ষণ নিয়ে জিআই তারের বেষ্টনী বেড়া বাইন্ডিং কারখানায় অবসরে কাজ করেন। খামারের চাহিদা মিটেও খরচ বাদ দিয়েও ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা আয় হয় বলে উদ্যোক্তা কাজল জানান। তিনি আরো বলেন, ‘কোনও তফশিলি ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে এতদুর পর্যন্ত এসেছি। বহুমুখি উদ্যোগ নিয়ে খেটে খাওয়া মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য পাশে দাঁড়িয়েছি। মাসে লক্ষাধিক টাকা মজুরী দিতে হয়। মাঝে-মধ্যে হিমসিম খাই। এর পরেও হাল ছাড়িনা। খামারের কলেবর আরো বাড়া দরকার। যদি কোন অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যাংক পাশে দাঁড়ায় সেক্ষেত্রে আমার প্রতিষ্ঠানটিকে লিমিটেড কোম্পানী হিসাবে রূপান্তরিত করতাম।’ এই উদ্যোগের মুল স্বপ্নদ্রষ্টা মোঃ কাওছার হোসেন রুবেল। তিনি কাজলের ছোট ভাই। সাধ্যমত সব ধরণের সহযোগিতা দিয়ে তিনি উৎসাহ যোগিয়ে পাশে থাকেন।
কিশোরগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার লোকমান আলম বলেন, কাজল একজন ভাল উদ্যোক্তা। সফলতার সাথে এগ্রো ফার্মটি পরিচালনা করায় বহু লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে।