সৈয়দপুর ০৩:৩৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ২৮ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ধাইজান নদীর বাঁকে কাশফুলের মুগ্ধতা

ফজল কাদির
  • আপডেট সময় : ০৯:৪৯:৫৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১১১ বার পড়া হয়েছে
চোখ২৪.নেট অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

ফজল কাদির: নীলফামারীর ধাইজান নদীর বাঁকে কাশফুল তার মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। প্রকৃতি প্রেমিকদের মন ছুয়ে দিচ্ছে এই অপরূপ সাজ। বেলে-দোআঁশ মাটির বুক চিরে শীর্ণকায় ধাইজান নদীর পাড় থাকে বালুময়। বর্ষার শুরুতে এই পাড়েই গজিয়ে উঠে নতুন ঘাস, বুনোগাছ ও কাশবন। যেন মরুভুমিতে মরুদ্যান। সবুজে ঢেকে যায় ধাইজান। ভাদ্র-আশ্বিনে বয়ে আনা শরৎকাল হয়ে উঠে আরো মোহনীয়।

এনেকেই একঘেয়ে জীবনের ফাঁকে ছুটে যান ওই মুগ্ধতার কাছে। মাথার উপর গাঢ় নীল আকাশ, সাদা কাগজের মত মেঘের ভেলা ভাসে সারি সারি। পাগলা হাওয়ায় সেই শুভ্র কাশবনে ছোট পাখিরা আনন্দে মেতে উঠে। মনের মধ্যে শুভ্রতার রেশ নিয়ে ঘরে ফিরেন প্রকৃতিপ্রেমিকরা।

গত শনিবার বিকেলে কাশবনে গিয়ে দেখা গেল, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেকে। কেউ এসেছেন বন্ধুবান্ধবসহ, কেউ এসেছেন পরিবার-পরিজন নিয়ে। কেউ কাশফুলকে জড়িয়ে ছবি তুলছেন, কেউ ছবি তুলছেন দল বেঁধে। একদল কিশোর-কিশোরী সেজেগুজে এসেছে। কাশফুলের সঙ্গে নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলছিল তারা। পাশেই ধাইজান নদী থেকে উত্তোলন করা বালু স্তুপ করে রাখা হয়েছে। সেই বালুর মধ্যে হেঁটে বেড়াচ্ছেন অনেকে। কাশফুল ছিঁড়ে হাতে নিয়ে ঘুরছে শিশুরা। এলাকার কৃষিজীবিরা তাদের ছাগল ও গরু চড়াচ্ছেন নদীর পাড়ে।

স্থানীয় ব্যাবসায়ী এমদাদুল হক তার স্ত্রী-সন্তানদের ধাইজান নদীতে এসেছেন কাশবন দেখাতে। পরিবারের সবাই খুশি। তাদের মধ্যে যেন উচ্ছ্বাস ঝড়ছিল।

তারা বলেন, শরৎ গেলে তো কাশফুল দেখা মিলবে না। তাই ঋতুরাণী শরতের অপরূপ দৃশ্য দেখে দুই নয়ন সার্থক করি। নদীর পাড়ে দেখা মেলে ৫০ পেরিয়ে যাওয়া শিক্ষক দেলোয়ার রহমানের সাথে।

তিনি বলেন, শরতে দেখা মেলে শীউলী, কামিনী, হাসনাহেনা, দোলনচাঁপা, বেলী, ছাতিম, রঙ্গন, টগর, জারুল, রাধাচূড়া, শ্বেতকান, নয়নতারা, ধুতুরা, মধুমঞ্জুরী, জিঙ্গে, জয়ন্তীমহ সহ নানা জাতের ফুল। এই ফুলগুলো খুবই মনোমুগ্ধকর।

থোকা থোকা কাশবনে নানা প্রজাতির পাখীর দেখা মেলে। এর মধ্যে অন্যতম হলো দাগি বাবুই। এরা কাশবন ও হোগলাবনে বাসা বাঁধে। এদের প্রধান খাবার ঘাসবীজ ও শস্যবীজ। কাশবনে আরো দেখা মেলে বনখঞ্জন পাখী। এছাড়া ছোট পাখীর তো দেখা মিলেই। এসব পাখী জলাধারের কাছে থাকতে পছন্দ করে। বনখঞ্জন পাখী ১৬-১৮ সেন্টিমিটার লম্বা। ঘাড়ের দুই পাশে জলপাই রঙ্গের মতো। বুক ও পেট সাদা। এর উপর চওড়া কালো দুটি দাগ রয়েছে। লেজের দুই পাশে পালক সাদা। চোখের উপড়ে সাদা বাঁকানো টান। হালকা গোলাপি পা। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে প্রায় একই মত।

শরৎ বয়ে আনে শীতের আগমনীবার্তা। শরৎকাল পেরিয়ে গেলে কাশবন শুকাতে থাকে। এলাকার ছিন্নমুলরা কাশফুল কেটে পাইকারের কাছে ছন, খড় ও ঝাটি বিক্রি করেন। এক আঁটি পাঁচ টাকা আর ভ্যান ভর্তি শুকনো ছন ৫শ থেকে ৭শ টাকায় বিক্রি হয় বলে কৃষিজীবি সোহাগী জানান। শরৎকাল শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই কাশবনের সাদা ফুল ঝরে পরে। তখনই এই কাজ শুরু করেন। ঝামেলাবিহীন ও উৎপাদন খরচ না থাকায় বেশ জনপ্রিয় এ কাজ। এতে স্থানীয় গরীব মানুষের দু’পয়সা আয় হয়, চলে জীবিকা। এছাড়া আশপাশের কয়েকটি অঞ্চলে কাশবন থেকে পাওয়া ছন, ঝাটি থেকে গৃহস্থালির বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সামগ্রী, শো-পিসসহ অনেক দৃষ্টিনন্দন জিনিস বানিয়ে থাকে তারা।

পরিবেশকর্মী আজহারুল ইসলাম বলেন, কাশফুলের চারদিক সবুজ শষ্যের দেখা মেলে। ধানের কচি পাতায় জমে থাকা শিশিরের উপর প্রভাত রবি দ্যুতি ছড়ায়। কৃষকরা নবান্নের আশায় দিন গুনে। শরতের রূপ লাবণ্য দেখে মোহিত না হয়ে পারে না কেউ। তাইতো প্রকৃতির এমন রূপ বাহারে কবি সাহিত্যিকের মনোজগতে উল্লাসের সৃষ্টি হয়। শরৎকে নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি। কবি গুরুও করে গেছেন শরতের বন্দনা। ‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলী, ছড়িয়ে গেল ছাড়িয়ে গেল অঞ্জলী। কবি নজরুল লিখেন- ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলী বিছানো পথে। শরৎ আমাদের প্রতিবারেই নতুন প্রেরণা জোগায়। হৃদয়কে রঙ্গিন করে তোলে শুভ্রতার স্পর্শে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শরৎকে তেমনভাবে পাওয়া যায়না। নদী কিংবা জলাধারে কাশবনকে দেখতে পাওয়া যায় না। তাই জীবনকে রঙ্গিন করতে হলে শরতের প্রধান উপজীব্য কাশফুলের জীবনকাল রক্ষায় আমাদের সজাগ থাকতে হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য


ধাইজান নদীর বাঁকে কাশফুলের মুগ্ধতা

আপডেট সময় : ০৯:৪৯:৫৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ফজল কাদির: নীলফামারীর ধাইজান নদীর বাঁকে কাশফুল তার মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। প্রকৃতি প্রেমিকদের মন ছুয়ে দিচ্ছে এই অপরূপ সাজ। বেলে-দোআঁশ মাটির বুক চিরে শীর্ণকায় ধাইজান নদীর পাড় থাকে বালুময়। বর্ষার শুরুতে এই পাড়েই গজিয়ে উঠে নতুন ঘাস, বুনোগাছ ও কাশবন। যেন মরুভুমিতে মরুদ্যান। সবুজে ঢেকে যায় ধাইজান। ভাদ্র-আশ্বিনে বয়ে আনা শরৎকাল হয়ে উঠে আরো মোহনীয়।

এনেকেই একঘেয়ে জীবনের ফাঁকে ছুটে যান ওই মুগ্ধতার কাছে। মাথার উপর গাঢ় নীল আকাশ, সাদা কাগজের মত মেঘের ভেলা ভাসে সারি সারি। পাগলা হাওয়ায় সেই শুভ্র কাশবনে ছোট পাখিরা আনন্দে মেতে উঠে। মনের মধ্যে শুভ্রতার রেশ নিয়ে ঘরে ফিরেন প্রকৃতিপ্রেমিকরা।

গত শনিবার বিকেলে কাশবনে গিয়ে দেখা গেল, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেকে। কেউ এসেছেন বন্ধুবান্ধবসহ, কেউ এসেছেন পরিবার-পরিজন নিয়ে। কেউ কাশফুলকে জড়িয়ে ছবি তুলছেন, কেউ ছবি তুলছেন দল বেঁধে। একদল কিশোর-কিশোরী সেজেগুজে এসেছে। কাশফুলের সঙ্গে নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলছিল তারা। পাশেই ধাইজান নদী থেকে উত্তোলন করা বালু স্তুপ করে রাখা হয়েছে। সেই বালুর মধ্যে হেঁটে বেড়াচ্ছেন অনেকে। কাশফুল ছিঁড়ে হাতে নিয়ে ঘুরছে শিশুরা। এলাকার কৃষিজীবিরা তাদের ছাগল ও গরু চড়াচ্ছেন নদীর পাড়ে।

স্থানীয় ব্যাবসায়ী এমদাদুল হক তার স্ত্রী-সন্তানদের ধাইজান নদীতে এসেছেন কাশবন দেখাতে। পরিবারের সবাই খুশি। তাদের মধ্যে যেন উচ্ছ্বাস ঝড়ছিল।

তারা বলেন, শরৎ গেলে তো কাশফুল দেখা মিলবে না। তাই ঋতুরাণী শরতের অপরূপ দৃশ্য দেখে দুই নয়ন সার্থক করি। নদীর পাড়ে দেখা মেলে ৫০ পেরিয়ে যাওয়া শিক্ষক দেলোয়ার রহমানের সাথে।

তিনি বলেন, শরতে দেখা মেলে শীউলী, কামিনী, হাসনাহেনা, দোলনচাঁপা, বেলী, ছাতিম, রঙ্গন, টগর, জারুল, রাধাচূড়া, শ্বেতকান, নয়নতারা, ধুতুরা, মধুমঞ্জুরী, জিঙ্গে, জয়ন্তীমহ সহ নানা জাতের ফুল। এই ফুলগুলো খুবই মনোমুগ্ধকর।

থোকা থোকা কাশবনে নানা প্রজাতির পাখীর দেখা মেলে। এর মধ্যে অন্যতম হলো দাগি বাবুই। এরা কাশবন ও হোগলাবনে বাসা বাঁধে। এদের প্রধান খাবার ঘাসবীজ ও শস্যবীজ। কাশবনে আরো দেখা মেলে বনখঞ্জন পাখী। এছাড়া ছোট পাখীর তো দেখা মিলেই। এসব পাখী জলাধারের কাছে থাকতে পছন্দ করে। বনখঞ্জন পাখী ১৬-১৮ সেন্টিমিটার লম্বা। ঘাড়ের দুই পাশে জলপাই রঙ্গের মতো। বুক ও পেট সাদা। এর উপর চওড়া কালো দুটি দাগ রয়েছে। লেজের দুই পাশে পালক সাদা। চোখের উপড়ে সাদা বাঁকানো টান। হালকা গোলাপি পা। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে প্রায় একই মত।

শরৎ বয়ে আনে শীতের আগমনীবার্তা। শরৎকাল পেরিয়ে গেলে কাশবন শুকাতে থাকে। এলাকার ছিন্নমুলরা কাশফুল কেটে পাইকারের কাছে ছন, খড় ও ঝাটি বিক্রি করেন। এক আঁটি পাঁচ টাকা আর ভ্যান ভর্তি শুকনো ছন ৫শ থেকে ৭শ টাকায় বিক্রি হয় বলে কৃষিজীবি সোহাগী জানান। শরৎকাল শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই কাশবনের সাদা ফুল ঝরে পরে। তখনই এই কাজ শুরু করেন। ঝামেলাবিহীন ও উৎপাদন খরচ না থাকায় বেশ জনপ্রিয় এ কাজ। এতে স্থানীয় গরীব মানুষের দু’পয়সা আয় হয়, চলে জীবিকা। এছাড়া আশপাশের কয়েকটি অঞ্চলে কাশবন থেকে পাওয়া ছন, ঝাটি থেকে গৃহস্থালির বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সামগ্রী, শো-পিসসহ অনেক দৃষ্টিনন্দন জিনিস বানিয়ে থাকে তারা।

পরিবেশকর্মী আজহারুল ইসলাম বলেন, কাশফুলের চারদিক সবুজ শষ্যের দেখা মেলে। ধানের কচি পাতায় জমে থাকা শিশিরের উপর প্রভাত রবি দ্যুতি ছড়ায়। কৃষকরা নবান্নের আশায় দিন গুনে। শরতের রূপ লাবণ্য দেখে মোহিত না হয়ে পারে না কেউ। তাইতো প্রকৃতির এমন রূপ বাহারে কবি সাহিত্যিকের মনোজগতে উল্লাসের সৃষ্টি হয়। শরৎকে নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি। কবি গুরুও করে গেছেন শরতের বন্দনা। ‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলী, ছড়িয়ে গেল ছাড়িয়ে গেল অঞ্জলী। কবি নজরুল লিখেন- ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলী বিছানো পথে। শরৎ আমাদের প্রতিবারেই নতুন প্রেরণা জোগায়। হৃদয়কে রঙ্গিন করে তোলে শুভ্রতার স্পর্শে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শরৎকে তেমনভাবে পাওয়া যায়না। নদী কিংবা জলাধারে কাশবনকে দেখতে পাওয়া যায় না। তাই জীবনকে রঙ্গিন করতে হলে শরতের প্রধান উপজীব্য কাশফুলের জীবনকাল রক্ষায় আমাদের সজাগ থাকতে হবে।