নির্মাণ শৈলী মুগ্ধ করে ঐতিহ্যবাহী চিনি মসজিদ

- আপডেট সময় : ০৪:৩১:৪২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪ ১৭৭ বার পড়া হয়েছে

ফজল কাদিরঃ দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে চিনি মসজিদের। মসজিদ নির্মাণের শুরুটা ছিল ইট ও সুরকি দিয়ে করা। নির্মাণ শৈলী সমৃদ্ধ করতে ২৪৩টি শংকর মর্মর পাথর মসজিদে লাগানো হয়। আর পাথরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ২৫ টনের মতো চীনামাটির টুকরা। বলা হয় দেওয়ালের ওপর চিনামাটির থালার ও কাচের ভগাংশ বসিয়ে কারুকাজ করা হয়েছে। পদ্ধতিটি চিনি করা বা চিনি দানার কাজ করা বলে সমধিক পরিচিত। তখন থেকেই মসজিদটির নাম হয়েছে চিনি মসজিদ। ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটি এ অঞ্চলের অন্যতম প্রাচীন মসজিদ হিসাবে খ্যাতি রয়েছে। চিনি মসজিদ শুধু ধর্মপ্রান মুসলমানদের উপাসনালয় নয়, এটি অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতীকও বটে।
নীলফামারী জেলার বানিজ্যিক শহর সৈয়দপুর। বাংলাদেশের প্রাচীন শহরগুলোর মধ্যে এই শহরটি ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য অনেক আগ থেকেই প্রসিদ্ধ। এখানে রয়েছে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের গড়ে তোলা সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা। এই শহরের প্রাচীন সৌন্দর্যের স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে অনেক। এর মধ্যে চিনি মসজিদ অন্যতম। যা অনকের কাছে চীনা মসজিদ নামে বেশি পরিচিত। সৈয়দপুর রেলস্টেশন- সৈয়দপুর ওয়াপদা সড়ক সংলগ এর অবস্থান। পাশেই রয়েছে খ্রিষ্টানদের কবরস্থান। জায়গাটির নাম ইসলামবাগ। এখানে কবরস্থানটির ঠিক পাশে ইতিহাসের গল্পের মতো দাঁড়িয়ে আছে চিনি মসজিদ। চিনি মসজিদটির বর্তমান ইমাম ও খতিব মাওলানা সাঈদ রেজা।
বাংলাদশর আনাচে-কানাচে মুঘল শাসক ও অন্যান্য মুসলিম নবাবদের হাতে নির্মিত অনক মসজিদ কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেবল এটিই একমাত্র মসজিদ যা এলাকাবাসী ও সর্বসাধারণর সার্বিক ব্যবস্থাাপনায় নির্মিত হয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। মসজিদের নিজস্ব সম্পত্তি বলতে আছ শুধু ১২টি দোকান। এসব দোকানের ভাড়া ও মুসল্লিদের অর্থসহায়তা দিয়ে মসজিদের সব ব্যয় ও উনয়নমূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করা হয়।
মসজিদের সুদীর্ঘ ইতিহাস বলছে ১৮৬৩ সালে হাজী বাকের আলী ও হাজী মুকু নামের দুজন ধর্মপ্রাণ বাসিন্দা সৈয়দপুর শহরের ইসলামবাগ এলাকায় ছন ও বাঁশ দিয় প্রথম মসজিদটি নির্মাণ করছিলেন। পরবর্তীতে এলাকাবাসীর সহায়তায় তা টিনের ঘরে রপান্তরিত হয়। ১৯২০ সালে হাজী হাফিজ আবদুল করিমের উদ্যাগে মসজিদটির প্রথম অংশ পাকা করা হয়। পর এলাকার লোকেরা মসজিদটি নির্মাণের লক্ষ্যে একটি তহবিল গঠনে উদ্যাগী হয়। স্থানীয়রা তাদের মাসিক আয়ের একটি অংশ দান করে মসজিদ নির্মাণের জন্য একটি তহবিল গঠন করেন। এরপর শুরু হয় মসজিদের নির্মাণ কাজ।
লোকমুখে শোনা যায়, শঙ্কু নামের জনৈক হিন্দু রাজমিস্ত্রী দৈনিক ১০ আনা মজুরিতে মসজিদের নির্মাণ কাজ নতুনভাবে শুরু করবন। স্থানীয় এলাকাবাসীর স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে তাকে সাহায্য করতে থাকে। মসজিদের সৌন্দর্য বাড়াতে মসজিদের দেয়াল চিনামাটির থালার ভগ্নাংশ ও কাঁচের ভগ্নাংশ বসানো হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় চিনি করা বা চিনি দানার কাজ করা। এখান থেকেই মসজিদের নাম হয়- চিনি মসজিদ বা চীনা মসজিদ।
১৯৬৫ সালে বগুড়ার একটি গ্যাাস ফ্যাক্টরি চিনা মসজিদের জন্য প্রায় ২৫ টনের মতো চীনামাটির পাথর দান করেছিল। এ ছাড়া সে সময় কলকাতা থেকেও ২৪৩টি শংকর মর্মর পাথর এনে লাগানো হয় এই মসজিদে। ঐতিহাসিক এই মসজিদের নকশা করেন মো. মাখতুল ও নবী বক্স। মসজিদের অনন্য কারুকার্য্যে সত্যিই মুগ্ধ হতে হয়। মসজিদের দেয়াল অঙ্কিত ফুলদানি, ফুলের ঝাড়, গোলাপ ফুল, একটি বৃত্ত একটি ফুল, চাঁদতারাসহ নানা চিত্র রয়েছে। এ মসজিদ তৈরিতে প্রচুর মার্বেল পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। চিনি মসজিদের সৌন্দর্য দেশ- বিদেশের প্রচুর পর্যটককে আকর্ষণ করে বলেই তারা ছুটে আসেন। নিজ চাখ দেখলে চিনি মসজিদের সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যাবে না।
এই মসজিদের পিছনে রয়েছে খ্রিস্টানদের প্রাচীন একটি কবরস্থান। মসজিদে ২৪৩টি শংকর মর্মর পাথর রয়েছে। আরও রয়েছে ছোট ছোট ৩২টি মিনারসহ ৩টি বড় গম্বুজ। মসজিদে একসঙ্গে প্রায় পাঁচ শতাধিক লোক নামাজ আদায় করতে পারেন।
এই মসজিদে রয়েছে উত্তর ও দক্ষিণে দুটি ফটক। মসজিদের গোটা অবয়বে রঙিন চকচকে পাথর মোড়ানো। আর বারান্দা বাঁধানো সাদা মাজাইকে। মসজিদের দোতলায় একটি ভবনসহ একটি মেহমানখানা আছে। সেখান পর্যটকদের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে।